নতুন প্রকাশনা সমূহ:

পরিকল্পনামন্ত্রী বললেন, মানুষকে স্বপ্ন দেখানোই বড় কাজ। কথা সত্যিই

বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে এক অপার বিস্ময়ের নাম। স্বাধীনতার ৪৬ বছরে তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ থেকে বেরিয়ে এসে আজ খাদ্যশস্যে, ফলে-ফসলে উপচে পড়া একটি দেশ। জাতিসংঘের মানব উন্নয়নের বেশ কয়েকটি সূচকে প্রতিবেশী দেশের তুলনায় ভালো অবস্থান আমাদের। শুধু একটি সূচক গড় আয়ু প্রায় ৭১ বছর দিয়ে সামাজিক খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি বোঝা যায় সহজেই। উন্নয়ন সাংবাদিকতা, আরো নির্দিষ্ট করে বললে গ্রামীণ জনপদ, কৃষি, পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক মানুষ নিয়ে কাজ করছি ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে। এই সময়ে নিবিড়ভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে দেশের উন্নয়নের চালচিত্র। চরম আনন্দ নিয়ে যেমন দেখেছি হাকিম আলী, পেঁপে বাদশা, পেয়ারা আতিক, গাজর জাহিদুল, হ্যাচারি নূরুল হকদের এগিয়ে যাওয়া। আহতও হয়েছি নীতিনির্ধারকদের সামান্যতম উদাসীনতায় ছোট ছোট উদ্যোগ ভেস্তে যেতে দেখে। অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই নিজেদের গল্পকে সাফল্যের গল্পে পরিণত করছেন আমাদের উদ্যোক্তারা। দেশকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন। উন্নয়ন সাংবাদিকতার এই দীর্ঘ যাত্রায় সুযোগ হয়েছে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সরকারপ্রধান ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে উন্নয়ন ইস্যু নিয়ে কথা বলার। আমার ব্যক্তি অবস্থানের উন্নয়ন দর্শন ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন বাস্তবতা ঝালিয়ে নিতেই সম্প্রতি বসেছিলাম পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে। ঘণ্টাখানেকের আড্ডা। এর মধ্যে উঠে এসেছে নানা বিষয়। আলোচনা করেছি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের আজকের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছনোর বিষয়গুলো নিয়ে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভারতসহ সব বড় দেশই বাংলাদেশকে অংশীদার হিসেবে পেতে চায় এখন। অথচ এদের অনেকের সাহায্য-সহযোগিতায় একসময় বাংলাদেশের বাজেট হতো। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি নিশ্চয়ই গর্বের।

পরিকল্পনামন্ত্রী কথা বলেছেন সমসাময়িক উন্নয়ন ইস্যু, গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের প্রাধিকার, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি, অপচয়, সময়ক্ষেপণ নিয়ে। দারুণ আশাবাদী মানুষ তিনি। তা ছাড়া উন্নয়নের সমীকরণ বা অঙ্কগুলো তাঁর কাছে পরিষ্কার। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ কিভাবে দারিদ্র্যসীমা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসবে সে সম্পর্কে তাঁর রয়েছে নিশ্চিত এক নকশা। সেখান থেকেই তিনি উচ্চারণ করেন, একজন মানুষও না খেয়ে থাকবে না। প্রতিটি শিশু স্কুলে যাবে। এমন একটি জীবনমানকে সামনে রেখে এই সময়কে ইতিহাসের পালাবদলের অধ্যায় বা ‘ট্রান্সফরমেটিভ পিরিয়ড’ বলতে চান তিনি। পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে ২০৩০ সাল নাগাদ পুরো অর্থনীতিকে জ্ঞানভিত্তিক করতে তাঁর রয়েছে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। তাই বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা যখন ২০৩০ সালে বাংলাদেশকে ২৩তম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে আগাম বিবেচনা করে, তিনি তখন বলেন, ওই সময় বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতি। তবে সুশাসন নিশ্চিত না হলে এত এত ভালো কথা কথাই থেকে যাবে, শঙ্কা তাঁরও। তিনি বলেন, সরকারের প্রচেষ্টায় দুর্নীতি কমছে। তবে তাঁর হিসাবেও রয়েছে, উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণও এক ধরনের দুর্নীতি। এ কারণেই বারবার প্রকল্প সংশোধন হয়, বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। চূড়ান্তভাবে ভোগান্তির শিকার হয় জনগণ। তাঁর তাগিদ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপির আওতায় প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে হবে নির্ধারিত সময়েই।

গত ৩৫ বছর গ্রামে, মাঠে-প্রান্তরে ছুটেছি নিরন্তর। বর্তমান সময়টিকে আমি দেখি অবিশ্বাস্য সাফল্যের একটি সময় হিসেবে। অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে সবখানে। প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজস্ব জীবনমান উন্নয়নের তাগিদেই সংগ্রাম করে যাচ্ছে। সেখানে সরকারের নীতি-সহায়তা তো আছেই। বিষয়গুলোর সঙ্গে একমত পরিকল্পনামন্ত্রী। তাঁর মতে, আমাদের সক্ষমতা কাউকে অঙ্ক কষে বোঝানোর দরকার নেই। আজকের এ উন্নয়নের উপকারভোগী আমরা সবাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় কোনো খাত নিয়েই স্বপ্ন দেখার কিছু ছিল না। আমাদের স্কুল-কলেজ ছিল না। মাত্র ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, তা-ও সরকারি। আজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক, এর অধিকাংশই বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। কৃষি উত্পাদনেও অকল্পনীয় সাফল্য আমাদের। আমাদের ফসলের ছিল না কাঙ্ক্ষিত ফলন। ছিল না আধুনিক কৃষি, সেচব্যবস্থা। পুরোপুরি নির্ভরতা ছিল প্রকৃতির ওপর। সেই অবস্থা আজ আর নেই। স্বাধীনতার পরপরই এ দেশে ধানের উত্পাদন ছিল ১১ মিলিয়ন টন। সেই ১১ মিলিয়ন থেকে আজ খাদ্যশস্যের উত্পাদন ছাড়িয়েছে ৩৯ মিলিয়ন টন। খাদ্য উত্পাদনের এই হারে কিন্তু মানুষ বাড়েনি। গত ১২ মাসে এক ছটাক চালও বাইরে থেকে আসেনি। আগের মতো মঙ্গা, হতদরিদ্র, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি কোথাও নেই।

মন্ত্রীর কথা শুনছিলাম। সেই সঙ্গে আমার কল্পনা ঘুরছিল গ্রামে গ্রামে। এই তো গত সপ্তাহেই মেহেরপুরের কাঁঠালপোঁতা গিয়েছিলাম শীতকালীন সবজি আবাদ নিয়ে প্রতিবেদন করতে। আগাম শিম চাষ করে ওই এলাকার কয়েক শ চাষি ভাগ্য বদল করেছে। অবাক করা ব্যাপার, বিঘাপ্রতি মাত্র আট হাজার টাকা খরচ থেকে কৃষকের আয় কমপক্ষে ৫০-৬০ হাজার টাকা। এলাকার প্রতিটি বাড়ি পাকা। এর পরও ২৬ অক্টোবর জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ডাব্লিউএফপি এনইসি মিলনায়তনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অর্থনীতিবিদ এস আর ওসমানীর নেতৃত্বে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে এক কোটি ১০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তায় ভুগছে, প্রায় চার কোটি মানুষ ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়। বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিশু অপুষ্টির শিকার, খর্বাকৃতির শিশু আমাদের আরেকটি বড় সমস্যা। এতে বছরে প্রায় উত্পাদনশীলতা থেকে এক বিলিয়ন ডলার হারিয়ে যাচ্ছে বলেও দাবি তাদের। এ প্রতিবেদন নিয়ে আমার নিজেরই প্রশ্ন রয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রীও বললেন, যারা এটা বলে তারা আসলে আমাদের দারিদ্র্য পরিমাপের যে উঁচু স্তর ও নিচু স্তর হিসাব করি সেটা গুলিয়ে ফেলে। উঁচু স্তরের দরিদ্র মানুষ তারা, যাদের ঘরে খাবার আছে, সব কিছু স্বাভাবিক, এর পরও তাকে আমরা দরিদ্র বলি। কারণ সে স্বচ্ছন্দে নেই। কোনো না কোনো নিরাপত্তার শঙ্কা আছে তার। তাকেও আমরা দরিদ্র বলি। আবার হতদরিদ্র হলো, যারা দুই হাজার ক্যালরির নিচে খাবার খায়। পুষ্টির অভাব আছে। হতদরিদ্র মানেই কিন্তু এটা নয় যে তার ঘরে খাবার নেই। দারিদ্র্য পরিমাপের এই সংজ্ঞা অর্থনীতিবিদদের অজানা নয়। মন্ত্রী বলেন, ২০০৫ সালে ৪০ শতাংশ মানুষ ছিল দরিদ্র। ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল এই সময়ে দারিদ্র্যসীমা আমরা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছি। সারা বিশ্ব স্বীকার করছে এটা। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বহুজাতিক সংস্থাগুলোও স্বীকৃতি দিয়েছে এই সাফল্যের। শুধু আমাদের দেশের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ এটা অস্বীকার করে। কয়েক দিন আগে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলে গেছেন, অস্বাভাবিক সফলতার দেশ হলো বাংলাদেশ। তিনি অবিশ্বাস্য সাফল্যের গল্প শুনে গেছেন বাংলাদেশ থেকে। এমনকি তিনি বলে গেছেন, বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উপযোগী করে অন্য দেশে প্রয়োগ করবেন।

পরিকল্পনামন্ত্রী দেশের দারিদ্র্য নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা সম্পর্কে বলেন, গবেষণা সংস্থাগুলো যদি নেতিবাচক কথা না বলে, তাহলে টাকা পাবে না। তাদের আয়ের মূল উৎস বাইরে থেকে আসা তহবিল। বাংলাদেশকে যত গরিব বলতে পারবে তত বেশি টাকা পাবে। দেশে গরিব নেই, মানে তাদের কাজও নেই। গবেষকদের মূল কাজ হওয়া উচিত গরিবদের নিয়ে কাজ করা। দারিদ্র্য দূর করার নীতি-কৌশল বের করা। কিন্তু এটা তাঁরা করবেন না, তাঁরা কখনোই গ্রামে যান না। এমনকি ঈদের সময়ও যান না। তাঁরা কিভাবে গ্রামের গরিব মানুষ সম্পর্কে জানবেন? তাঁদের দেশের প্রতি মমতা নেই।

আবারও সুশাসনের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। সুশাসন না থাকলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি অর্জন কঠিন হবে। উন্নয়ন প্রকল্প, বিশেষ করে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ব্যাপক। এমনকি চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় সরকারি এক ভবন নির্মাণে রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে। ঢাকা তো বটেই, সারা দেশে জনগণের করের টাকায় যেসব রাস্তা নির্মিত হয়, তার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এমনকি ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের অবস্থাও এরই মধ্যে খারাপ হয়ে গেছে। বছরের পর বছর সময়ক্ষেপণ করে নির্মিত মহাসড়কের গুণগত মান নিয়ে চরম অসন্তোষ রয়েছে মন্ত্রী মুস্তফা কামালের। এর পরও সব সময় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর। তিনি বলেন, উন্নয়নের ধারা শুরু হয়েছে।

মন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প, এমআরটি, মেট্রো রেল, রামপালে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় প্রকল্প আমরা আগে কখনো করিনি। আমাদের সক্ষমতার অভাব তো আছেই। এটা করতে গিয়ে কিছু বিচ্যুতি তো হবেই, অসংগতিও হবে, অপচয়ও হবে। এর পরও প্রবৃদ্ধি সঞ্চারী বড় অন্য ১০টি প্রকল্প আগামী দুই বছরের মধ্যে দৃশ্যমান হবে। কয় দিন পর পর একটা বাধা আসে। গত দুই বছর আগে দেশে গাড়ি পোড়ানো, মানুষ পোড়ানো শুরু হলো। এতে চার থেকে ছয় মাস চলে গেল। প্রতিটি বড় প্রকল্পের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগীরা জড়িত থাকে। প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিটি পর্যায়ে তারা নিজেরাই নজরদারি করে। আমরা শুধু কাজটা করি। যেকোনো বড় প্রকল্পের নকশা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি তাদের অনুমোদন ছাড়া আমরা ঠিকাদারও নিয়োগ দিতে পারি না। পদ্মা সেতু ছাড়া অন্য সব বড় প্রকল্পে আমাদের কোনো না কোনো উন্নয়ন সহযোগী জড়িত। কাজেই প্রকল্পের গুণগত মান নিয়ে আমরা যেমন যত্নশীল, উন্নয়ন সহযোগীরাও তেমন। কারণ তারা জানে প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়ন যদি না হয়, তাহলে টাকা তো ফেরত যাবে না।

চার লেন প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি, চার লেনে আমাদের কিছু ভুলভ্রান্তি হয়েছে, অপচয় হয়েছে, সময় বেশি লেগেছে। যখন আমরা কোনো রাস্তার ঘোষণা দিই তখন স্থানীয় অনেক দুষ্ট লোক রাতের বেলা শালু কাপড় টানিয়ে দেয়, অমুক বাবার মাজার। মামলা করে দেয়। এসব মোকাবিলা করে কাজটা করতে হয়। সুতরাং এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় বিলম্ব হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে যখন অহেতুক বিলম্ব হয় তখন অপচয় তো হবেই। মনে রাখতে হবে, টাইম ইটসেল্ফ হ্যাজ এ কস্ট।

মন্ত্রীর দৃষ্টি আকৃষ্ট করলাম পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ সেতুসহ যশোর পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন, ঢাকা-খুলনা হাইওয়ের যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া পর্যন্ত অংশের সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন স্থাপন প্রকল্পে নির্মাণ ব্যয় নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার বিষয়ে। পত্রপত্রিকায় অসংখ্য প্রতিবেদন হয় কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় নিয়ে। গণমাধ্যমের সেসব খবরের সারবত্তা হলো নির্মাণ ব্যয় পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। পরিকল্পনামন্ত্রী অবশ্য এ অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, চীন কিংবা ভারত তো বটেই, এমনকি জাপানের টোকিওর চেয়েও এখানে জমির দাম বেশি। জমি কেনা ও পুনর্বাসনেই প্রকল্পের ৫০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়ে যায়। চীনে সব জমির মালিক সরকার। আমাদের সব জমির মালিক তো সরকার নয়। এসব কারণে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। এর আরেকটি বড় কারণ বাস্তবায়নে বিলম্ব। আর দুষ্ট লোকের হীন উদ্দেশ্য তো আছেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কথা। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী আমরা কাজ করতে পারি না অনেক সময়। এ জন্য এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের চিন্তা। আমি মনে করি, কাজ হওয়া দরকার।

কৃষকের সমস্যা, সম্ভাবনা, গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সাম্প্রতিককালে শুধুই মনে হয় আমাদের জিডিপি আরো বেশি হওয়া উচিত। সন্দেহ হয়, অর্থনীতির অনেক লুকানো জায়গা হয়তো পরিসংখ্যান ব্যুরোর ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস উইংয়ের হিসাবে আসে না। এ কৌতূহল থেকেই আমরা চ্যানেল আইয়ে লুকানো অর্থনীতি নামে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন করেছিলাম। অনেকেরই ধারণায় নেই, আমরা প্রতিদিন শুধু চা পানেই কত টাকা খরচ করি। দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী যদি ১০ কোটি হয়, তার ন্যূনতম পক্ষে দুই কোটি মানুষ দৈনিক পাঁচ কাপ চা খায়। তাহলে দিনে ১০ কোটি কাপ পাঁচ টাকা দাম ধরলে ৫০ কোটি টাকার চা পান ব্যয় প্রতিদিন, মাসে দেড় হাজার কোটি টাকা, বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয় শুধু চা পানে; যা পদ্মা সেতুর শুরুর দিককার প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রায় সমান। এই শীতে খুব কম মানুষ পাওয়া যাবে, যারা দু-চারটা গরম কাপড় ব্যবহার করবে না। মানুষের এই যে ক্রয়ক্ষমতার বৃদ্ধি, অর্থনীতির এই যে বিকাশ, তার কৃতিত্ব কি সরকার সূক্ষ্মভাবে নিজের ঘরে নিতে পারছে? আমাকে বুঝিয়ে বললেন কিভাবে জিডিপির হিসাব হয়। জিডিপির হিসাব হয় উত্পাদনের ভিত্তিতে, আবার ব্যয়ের ভিত্তিতেও জিডিপির হিসাব হয়। তবে মন্ত্রী একমত হলেন, কিছু কিছু লুকানো খাতকে এখনো আমরা জিডিপিতে আনতে পারিনি। দেশের জিডিপি ২২০ বিলিয়ন ডলার। এটি ছোট অঙ্ক নয়। গত বছরে জিডিপির হিসাবে দুটি খাতকে আমরা আনতে পারিনি, ভিত্তি বছরের কারণে। আমাদের ভিত্তি বছর ছিল ২০০৫ সাল। এটা প্রতি ১০ বছর পর পর পরিবর্তন হয়। অবশ্য অনেক দেশ পাঁচ বছর পর পরিবর্তন করে। কারণ আমাদের মতো উদীয়মান দেশে অর্থনীতিতে নতুন নতুন খাত যুক্ত হচ্ছে। এতে পরিধিও বড় হচ্ছে। যেমন আমাদের আগের হিসাবে আইসিটি ছিল না, মোবাইল ব্যাংকিং ছিল না। কিন্তু এটা তো বিরাট এলাকা। আগে জিডিপিতে রেমিট্যান্সটাও আনা হতো না। তবে মাথাপিছু আয়ে ধরা হতো। কিন্তু রেমিট্যান্সের একটা বড় অংশ বিনিয়োগে চলে আসে। যেমন কেউ একটা মুরগির ফার্ম করে, কেউ একটা মেশিন কেনে, তা দিয়ে হয়তো ধান ভাঙার কল বানায়। এগুলো তো উত্পাদনে সরাসরি মূল্য সংযোজন করে। ভিত্তি বছর পরিবর্তন করব না। কিন্তু এ খাতগুলো জিডিপিতে ঢুকবে।

মন্ত্রী বলেন, জিডিপির আকার বড় না হলে গত ১০ বছরে দারিদ্র্য এত দ্রুত কমত না। আমি বলতে চাই, যারা আমাদের জিডিপির হিসাব মানে না তারাই বলুক আমাদের জিডিপি কত? জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হিসাব করতে গিয়ে সব দেশই কিন্তু প্রক্ষেপণ করে। প্রক্ষেপণ আর বাস্তবতা কিন্তু এক না। আমরাও প্রক্ষেপণ করেছিলাম। বছরের প্রথমে বলেছিলাম জিডিপি হবে ৭.০৫ শতাংশ। কিন্তু চূড়ান্তভাবে হয়েছে ৭.১১ শতাংশ। এটা বিশ্বব্যাংক, এডিবি সবাই গ্রহণ করেছে। কিন্তু দেশের দু-একজন মানতে পারেনি। কারণ তাদের প্রক্ষেপণ ছিল বাংলাদেশের মানুষ হয়তো এর চেয়ে বেশি অর্জন করতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তো আগের জায়গায় নেই। আমার লক্ষ্য, ২০২০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ১০ শতাংশে নিতে চাই। এটা হবে একটা অসাধারণ সফলতা। জিডিপি প্রবৃদ্ধি আসে বিনিয়োগ থেকে। প্রবৃদ্ধি আসে মাথাপিছু উত্পাদন সক্ষমতা বাড়াতে পারলে। আমাদের বিনিয়োগও বাড়ছে। গতবার ২৯ শতাংশের কম ছিল; এবার ৩০ শতাংশের কাছাকাছি গেছে। একদিকে আমাদের বিনিয়োগ বাড়ছে, আবার মানবসম্পদের গুণগত মান বাড়ছে। আরেকটি কারণ আমাদের জনসংখ্যার ৭৬ শতাংশ কর্মক্ষম। এসবের একটা সুফল তো আমরা পাব। এ দেশে ফরমাল ইকোনমির বাইরে আরেকটি ইনফরমাল অর্থনীতি আছে, যা ফরমাল অর্থনীতির মতোই বড়।

মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলাম কৃষকের জন্য, গ্রামের অর্থনীতির জন্য কী করছেন? কারণ রেমিট্যান্সের সিংহভাগ পাঠায় গ্রামের কৃষকের সন্তানরা। অর্থনীতির আরেক চালিকাশক্তি গার্মেন্টশিল্প। সেখানেও কর্মরত শ্রমিকের ৮০ শতাংশই গ্রাম থেকে আসা। যদি ৪০ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিকের ৮০ শতাংশ অর্থাত্ ৩২ লাখ শ্রমিক প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে গ্রামে পাঠায়, তাহলে সে অঙ্কটি দাঁড়ায় ৬৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া আছে রেমিট্যান্সের বিপুল অঙ্ক, কৃষি উত্পাদন ও ক্ষুদ্র ব্যবসার অর্থনৈতিক অবদান। অর্থনীতিতে প্রান্তিক মানুষগুলোর এই যে অবদান তার স্বীকৃতি কি সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গুরুত্ব পাচ্ছে? মন্ত্রীর উত্তরে আশ্বস্ত হলাম। তিনি জানালেন, পুরো বাংলাদেশকে একটি বাংলাদেশ হিসেবে দেখছে সরকার। এখানে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম কোনো ফারাক নেই। পুরো বাংলাদেশ একটি করিডর। চট্টগ্রাম থেকে রংপুর বা রাজশাহী থেকে বগুড়া তা নয়। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে পুরো বাংলাদেশ একটা সুপার করিডর। সেই বিবেচনায় আমরা দেশটাকে সাজাচ্ছি। কোনো আঞ্চলিকতা নেই। সবার জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন প্রয়াস। সবার জন্য উন্নয়ন। আর আমাদের উন্নয়নের সৌন্দর্য হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। আমরা কাউকে পেছনে ফেলে যেতে চাই না। আমাদের ৫৬ লাখ মানুষ আছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। উত্পাদনশীলতা বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, যতক্ষণ এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অর্থনীতির মূলধারায় না আসে, যতক্ষণ তাদের জীবনমান উন্নত করতে না পারছি ততক্ষণ আমাদের অর্থনীতি টেকসই না। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাতিসংঘ কারো বলার দরকার নেই। এসডিজি অর্জন করতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থে।

পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মনে করেন, তাঁর মন্ত্রণালয় তৃণমূলের মানুষের উন্নয়নে কাজ করার সবচেয়ে ভালো জায়গা, সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য কাজ করার মন্ত্রণালয়। কারণ সব উন্নয়ন প্রকল্প এখান থেকেই প্রণীত হয়। মন্ত্রী বললেন, আগে হয়তো এমন সুযোগ ছিল না। আমি সুযোগ পেয়েছি, কাজে লাগাতে চাই। এটা আমার কাজের স্টাইল। আমি ক্রিকেটেও তা-ই করেছি। নতুনত্ব নিয়ে কাজ করতে চাই। সনাতনী কাজে আমি বেশি সময় নষ্ট করি না। আমার কাজ মানুষকে স্বপ্ন দেখানো। আমি সারা দিন একা কাজ করলাম; কিন্তু মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারলাম না, কাজ হবে না। আমি যদি ১০ জন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি, তাহলে দশ গুণ বেশি কাজ হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও একই কাজ করেন। আমাদের স্বপ্ন দেখান। নাম্বারভিত্তিক কাজ করেন। আমিও তা-ই করি।

প্রশ্ন থেকে যায় উন্নয়ন কাজের মান নিয়ে। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী তাঁর মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তিত চেহারাটি তুলে ধরলেন। তিনি বললেন, এখানে পরিবর্তন ও উন্নয়ন বিদেশ থেকে এসে কেউ করেনি। আমরাই করেছি। ধরুন মগবাজার ফ্লাইওভার প্রকল্পে কিছু ত্রুটির কথা আপনারা শুনেছেন। কিন্তু একই ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি কখনোই হবে না। আমরা যদি কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন দুই দিনও এগিয়ে আনতে পারি, সেটা হবে সাশ্রয়, দক্ষতার উন্নয়ন। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিবির আমরা ৯৩ থেকে ৯৪ শতাংশ বাস্তবায়ন করছি। এটাও কিন্তু দক্ষতার উন্নয়নের একটি সূচক। আগে ৮০ শতাংশের বেশি বাস্তবায়িত হতো না। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার সময় এডিপির প্রকৃত আকার ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকা। গত বছর আমরা খরচ করেছি প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। এ বছর করব এক লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতি হচ্ছে, তবে তা কমবে।

পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে ঘুরেফিরেই আলোচনা হলো কৃষি নিয়ে। তিনিও বিশ্বাস করেন, দীর্ঘকাল পরও আমাদের অর্থনীতির ভিত থাকবে কৃষি। গ্রামীণ অর্থনীতিই আমাদের শক্তি। জিডিপিতে কৃষির অবদান কেন কমছে তারও ব্যাখ্যা দিলেন মন্ত্রী। বললেন, যখন একটি দেশের উন্নতি হতে থাকে, অর্থনীতির যখন ট্রান্সফরমেশন হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই কৃষির অবদান জিডিপিতে কমতে থাকে। মনে হয় যেন কৃষি পিছিয়ে গেল। আসলে কিন্তু তা নয়। আমাদের মতো সব দেশেই একই ঘটনা ঘটছে। প্রথমে মোট কৃষির শেয়ার অনেক বেশি থাকে, আস্তে আস্তে শিল্প ও সেবা খাতের অবদান বাড়তে থাকে। আমাদের অর্থনীতি এখন পরিণত। কিন্তু তাই বলে কৃষির গুরুত্ব কিন্তু একটুও কমেনি। সরকার আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কৃষিতে অনেক বেশি মনোযোগী, এর ফলও মিলেছে। সারা পৃথিবীতে যত খাদ্যশস্য উত্পাদন হয় তার ৫ শতাংশ আমরা করি। কিন্তু পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর তুলনায় আমরা আড়াই ভাগেরও কম। সরকার কৃষককে বীজ দেয়, উপকরণ সহায়তা দেয় এমন নজির পৃথিবীতে বিরল।

মন্ত্রী চ্যানেল আইয়ে আমার অনুষ্ঠান ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর কথা তুলে ধরে বলেন, ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ফিরে এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি কৃষকের সমস্যা সম্পর্কে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট সবাইকে ডেকে তাগিদ দিয়েছেন সমস্যাগুলো সমাধানের। এসবের ফলই কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, তার অ্যাকাউন্টে প্রণোদনার অর্থ দেওয়া। আগে আমরা উপকরণ বেশি দিতাম, এখন সরাসরি অর্থ দিচ্ছি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। এতে অপচয়, চুরি, দুর্নীতি কমবে। আস্তে আস্তে এসব সেবা অনলাইনভিত্তিক হবে। মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের পরিসর আরো বিস্তৃত হবে।

দীর্ঘ তিন যুগের সাংবাদিকতায় অনেক তৃণমূল কৃষক থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক, এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের প্রভাবশালী বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়নবিদদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাঁদের উন্নয়ন চিন্তার ধরন পর্যবেক্ষণ করেছি। অনেক দিন পর আমাদের দেশ, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের প্রভাবশালী একজন মন্ত্রীর সঙ্গে সবিস্তারে খোলামেলা আলোচনার সুযোগ হলো। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ব্যক্তিত্বের ইতিবাচক দিক তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাসী ও দূরদর্শী একজন মানুষ। আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে আজ যে স্বপ্ন রচিত হচ্ছে, তা একদিন বাস্তবায়িত হবে—তাঁর বিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসী হতে চাই আমরাও। আমিও ব্যক্তি ও কর্মজীবনে বরাবরই আশাবাদী। সব কিছুই দেখতে চাই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। আমার বিশ্বাস, পরিশ্রমী ও আত্মবিশ্বাসী মানুষই দেশকে দাঁড় করাবে উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত সীমারেখায়।

 

লেখক : পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

Leave a Reply

Diploma Engineers

ডিপ্লোমা -ইন- ইঞ্জিনিয়ার ব্লগ ’ হচ্ছে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মতামত প্রকাশের একটি মাধ্যম যাতে ...
View

পূঞ্জিকা

March ২০২৪
Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
« Mar    
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১