কাঁকড়া চাষ করে আবারো উঠে দাঁড়াচ্ছেন চাষিরা। ঘের এলাকায় চিংড়ির মোকামগুলো কাঁকড়ার মোকামে রূপান্তরিত হচ্ছে। চিংড়ির আড়তের চেয়ে বাড়ছে কাঁকড়ার আড়তের সংখ্যা। সেকেলে– সনাতন পদ্ধতিকে পিছনে ফেলে উন্নত প্রযুক্তিতে উত্পাদন হচ্ছে কাঁকড়া। সনাতন পদ্ধতির কাঁকড়া চাষের মৌসুম মে থেকে ডিসেম্বর। আধুনিক ‘সফ্টেসল’ পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষ হচ্ছে সারা বছরই। উন্নয়ন সংস্থা কেয়ারের তথ্য বলছে, সুন্দরবন এলাকায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার জেলে পরিবার কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
কাঁকড়া রপ্তানি প্রতিবছর গড়ে আয় হচ্ছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। কাঁকড়া চাষে ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার ভয় নেই। নেই বিনিয়োগের ঝুঁকি। প্রক্রিয়াকরণে জটিলতা বা দ্রুত পচনেরও ভয় নেই। চিংড়ির মতো পোনা কিনতে হয় না কাঁকড়ার। প্রাকৃতিকভাবেই লোনা পানিতে কাঁকড়া জন্মায়। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এবং জুন থেকে জুলাই হচ্ছে কাঁকড়ার প্রজননকাল। এ সময় গভীর সমুদ্রে ও সুন্দরবনের মধ্যে ডিম থেকে কাঁকড়া জন্ম নেয়। এসব পোনা পানিতে ভেসে এসে নদ-নদী, খাল ও মাছের ঘেরে আশ্রয় নিয়ে বড় হয়। নদী থেকে ঘেরে পানি উঠালেই লাখ লাখ পোনা পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে সরকার কক্সবাজার ও খুলনা অঞ্চলে কাঁকড়া চাষ সমপ্রসারণের জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এবছর ‘ইরাওয়ান ট্রেডিং’ নামে কাঁকড়া উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় মত্স্য পুরস্কার জিতেছেন। কাঁকড়া এখন রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের অন্তত ২৪টি দেশে। ভিয়েতনাম, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশি কাঁকড়ার সুখ্যাতি। বৃহত্তর খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, কক্সবাজারসহ উপকূলে বহু এলাকায় হচ্ছে কাঁকড়ার চাষ। খুলনার পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, বাগেরহাটের রামপাল ও মংলায় ঘেরের পাশাপাশি খামারে তিন পদ্ধতিতে কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। একটি পদ্ধতিতে ছোট ছোট পুকুরে রেখে মোটাতাজা করা হচ্ছে কাঁকড়া, আরেক পদ্ধতিতে বড় বড় ঘেরে চিংড়ির সঙ্গে কাঁকড়ার পোনা ছেড়ে বড় করা হচ্ছে, আবার উন্মুক্ত জলাশয়ে খাঁচায় আটকে রেখেও চাষ করা হচ্ছে কাঁকড়া।
দক্ষিণাঞ্চলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েক হাজার কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ খামার গড়ে উঠেছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর, কালীগঞ্জ, আশাশুনি, দেবহাটা, খুলনার পাইকগাছা, কপিলমুনি, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া এবং বাগেরহাটের রামপাল ও মংলা উপজেলায় নয় শতাধিক মোটাতাজাকরণ খামার গড়ে উঠেছে। শুধু পাইকগাছাতেই রয়েছে ৩০০টি খামার। শ্যামনগরের কাঁকড়া খামারের মালিক হরিচরণ মালো জানান,মাত্র এক বিঘার কাঁকড়ার ঘেরে বছরে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাভ করা যায়। কাঁকড়া ঘেরে ছাড়ার পর ২০ থেকে ২৫ দিনেই তা বিক্রির উপযোগী হয়।
কক্সবাজারের কাঁকড়া চাষ হচ্ছে সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে। সেখানকার কয়েকজন চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাঁকড়া চাষের জন্য জমির আয়তন কোনো ব্যাপার নয়। প্রয়োজন নেট, পাটা, পুঁজি আর খাদ্যের। মহাজনের কাছ থেকে সবকিছুই বাকিতে আনা যায়। ফলে চাষিদের ওপর চাপ পড়ে না। প্রাকৃতিকভাবে আহরিত কাঁকড়ার মধ্যে যেসব কাঁকড়ায় মগজ কম বা নরম থাকায় বিদেশে রফতানি হয় না, সেসব কাঁকড়া ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। আর এ জন্য কাঁকড়া চাষের জমিকে নেট পাটা দিয়ে ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত করা হয়। পরে ওই নেট পাটার ঘেরার মধ্যে নরম কাঁকড়া ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর মাত্র ১২-১৫ দিনের মধ্যেই কাঁকড়া বিক্রির উপযোগী হয়ে ওঠে। পরে স্থানীয় ডিপো মালিকরা এগুলো কিনে নিয়ে ঢাকায় পাঠান। এক বিঘা জমিতে কাঁকড়ার চাষ করতে হলে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা পুঁজির প্রয়োজন হয়। এ থেকে মাসে তার ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় হয়।
২০০৩ সালে প্রথম কাঁকড়ার পোনা ও চাষ বিষয়ে গবেষণা শুরু করে বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজার সামুদ্রিক মত্স্য প্রযুক্তি কেন্দ্র। এরপর ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে ও আন্তর্জাতিক মত্স্য গবেষণা সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ফিশ’র অ্যাকুয়াকালচার ফর ইনকাম এন্ড নিউট্রিশন প্রকল্পের যৌথ তত্ত্বাবধানে কক্সবাজারের একটি হ্যাচারিতে কাঁকড়ার পোনা উত্পাদনে নিবিড় গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো জানাচ্ছে, দেশ থেকে ১৯৭৭ সালে প্রথম কাঁকড়া রফতানি হয়েছিল। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কাঁকড়া রফতানি হয়েছে ২ হাজার ৯৭৩ টন। ২০১১-১২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৪১৬ টনে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে কাকড়া রফতানি বেড়ে ৮ হাজার ৫২০ টনে পৌঁছায়। সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এর দ্বিগুণ কাঁকড়া রফতানি হয়েছে। এসব কাঁকড়ার বড় অংশ পাঠানো হয়েছে চীনে। এছাড়া মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, জাপান, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমার এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশ মিলিয়ে ২৪টি দেশে কাঁকড়া রফতানি হচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা মত্স্য কর্মকর্তা অমিতোষ সেন জানান, কক্সবাজারে মূলত দুই ধরনের কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। একটি সফ্ট শেল ক্র্যাব, অপরটি হার্ড শেল ক্র্যাব। হার্ড সেল ক্র্যাব জীবিত অবস্থায় এবং সফ্ট শেল ক্র্যাব হিমায়িত অবস্থায় বিদেশে রফতানি করা হয়। কক্সবাজার জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, সদর ও উখিয়ায় উভয় কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। অমিতোষ সেন বলেন, আগে মানসম্মত কাঁকড়া চাষের জন্য বিদেশ থেকে প্লাস্টিকের ঝুড়ি আনা হতো। এতে প্রতিটি ঝুড়ির পিছনে ব্যয় হতো ১৩০ টাকা। এখন দেশেই এসব ঝুড়ি তৈরি হচ্ছে। মাত্র ৩০ টাকায় ঝুড়ি পাচ্ছে কাঁকড়া চাষীরা।
আড়তদাররা জানালেন, কাঁকড়া ব্যবসা বেশ লাভজনক। বিশ্ববাজারে সুন্দরবনের কাঁকড়ার চাহিদা বেশি। বন থেকে যে কাঁকড়া ধরে আনা হয়, তা প্রথমে বাছাই করা হয়। শক্তগুলো রফতানির জন্য তৈরি করা হয় আর নরমগুলো মোটাতাজা করতে ঘেরে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে সেই কাঁকড়াগুলো আবার শক্ত হয়ে গেলে রফতানি করা হয়। খুলনার দাকোপ উপজেলা মত্স্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি ঘোষ বলেন, কাঁকড়া মোটাতাজা করে চাষীরা দ্রুত লাভবান হচ্ছেন। কাঁকড়া চাষ উন্নত করার জন্য সংশিষ্টদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পোনা উত্পাদন ও জীবিত কাঁকড়ার রফতানির পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাতকরণের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এতে আরো কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে।